প্রভু যিশু একবার এক বাড়িতে অবস্থান করছিলেন। নানা জায়গা থেকে অভ্যাগতদের দ্বারা ঘরটি এত পরিপূর্ণ ছিলো যে, দরজা দিয়ে আর একজনেরও প্রবেশের সুযোগ ছিলো না। এ অবস্থায় এক চলৎশক্তিহীন অবশ রোগীকে নিয়ে হাজির হলো তার বন্ধুরা। তাদের বিশ্বাস ছিলো যে, প্রভু যিশুর কাছে গেলেই সে নিরাময় হয়ে যাবে। কিন্তু ভেতরে প্রবেশের কোনো সুযোগ না পেয়ে তারা হতাশ হচ্ছিলো। অগত্যা এক উপায় অবলম্বন করলো। ঘরের চালার একটা অংশ খুলে তার ভেতর দিয়ে নামিয়ে দিলো দড়িবাঁধা বিছানায় শোয়া সেই অবশ রোগীকে। যিশু তাদের বিশ্বাসের দৃঢ়তা দেখে বললেন, বাছা! প্রভু তোমাকে ক্ষমা করেছেন। উঠে দাঁড়াও এবং বিছানা হাতে নিয়ে চলে যাও। সবার বিস্মিত দৃষ্টির সামনে লোকটি তা-ই করলো।
আরেকবার সঙ্গীদের নিয়ে যিশু জেরুজালেম ত্যাগ করছেন। জেরিকোর কাছাকাছি পৌঁছে দেখলেন, পথের ওপর এক অন্ধ ভিক্ষুক বসে আছে। বার্টিমোস নামের এই ভিক্ষুক চিৎকার করে বলতে লাগলো, হে যিশু, আমাকে দয়া করুন। তার সঙ্গীরা তাকে নিরস্ত করার চেষ্টা করলো। কিন্তু তাতে কর্ণপাত না করে বার্টিমোস আরো জোরে জোরে যিশুকে ডাকতে লাগলো। যিশু থামলেন। অন্ধ ভিক্ষুকটিকে তার কাছে নিয়ে আসতে বললেন। তিনি বললেন, তুমি কী চাও? বার্টিমোস বললো, আমি আমার দৃষ্টি ফিরে পেতে চাই। যিশু বললেন, তা-ই হবে। তোমার বিশ্বাসই তোমাকে নিরাময় করবে। তৎক্ষণাৎ বার্টিমোস দৃষ্টি ফিরে পেলেন এবং পরিণত হলেন তাঁর অনুসারীতে।
বিশ্বাস ছিলো প্রভু যিশুর প্রথম শিক্ষা। তিনি বিশ্বাস করেছেন এবং বিশ্বাসী হতে বলেছেন। দীক্ষিত হওয়ার পর ৪০ দিন-রাতের উপবাস ব্রতের সময় শয়তানের নানা বিভ্রান্তি-চেষ্টাকে তিনি নস্যাৎ করে দিয়েছেন বিশ্বাসের দৃঢ়তা দিয়ে। প্রথমবার শয়তান তাকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা করলো তার ক্ষুৎপিপাসা কাতরতার সুযোগে। তাকে বললো- হে যিশু, তুমি যদি সত্যই প্রভুর আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে থাকো, তাহলে এ পাথরকে বল রুটি হয়ে যেতে। যিশু বলেছিলেন, শুধু দেহের খাবার নয়, ঈশ্বর নিঃসৃত বাণী মানুষকে বাঁচিয়ে রাখে।
দ্বিতীয়বার শয়তান তাকে পৃথিবীর ভূ-ভাগের দৃশ্য দেখিয়ে বললো, আমার আনুগত্য করলে তোমাকে এ সমস্ত রাজ্যের অধিপতি করে দেবো। যিশু বলেছিলেন, আনুগত্য তো কেবল ঈশ্বরেরই প্রাপ্য। উপাসনা তো তাঁরই একাধিপত্য। তৃতীয় এবং শেষবারের মতো শয়তানের ধোঁকাকেও তিনি জয় করেছেন বিশ্বাসের শক্তি দিয়ে।
দ্বিতীয় শিক্ষা হলো প্রত্যাশা। যিশু বলেছেন, যারা ধৈর্যের সাথে সৎকর্ম করে ঈশ্বরের কাছে সুখ-সম্মান ও অনন্ত জীবন প্রত্যাশা করে, ঈশ্বরও তা-ই দেবেন।
আর তৃতীয় হলো মমতা। যিশু বলেন, বিশ্বাস প্রত্যাশা ও মমতা- এ তিনটিই শেষ পর্যন্ত টিকে থাকে। এর মধ্যে মমতাই সবচেয়ে মহৎ। এই মমতা এমনকি শত্রু বা বিরোধিতাকারীর জন্যেও। তিনি বলেন, যে তোমার শত্রুতা করে, তাকে ভালবাসো। যে তোমাকে ঘৃণা করে তার কল্যাণ কর। আর যে তোমার সাথে দুর্ব্যবহার করে, তার জন্যে প্রার্থনা কর।
সারাজীবন যিশু তা-ই করেছেন। এমনকি ক্রুশবিদ্ধ করার জন্যে যখন সাধারণ কয়েদীদের সাথে তাকেও বেঁধে আনা হচ্ছিলো তখনও তিনি ঈশ্বরের কাছে এ প্রার্থনাই করছিলেন যে, হে প্রভু! তুমি এদের ক্ষমা কর। কারণ এরা জানে না, এরা কী করছে।
উদারতা আর সহিষ্ণুতার এক মূর্ত প্রতীক ছিলেন যিশু। একবার ব্যভিচারের দায়ে এক মহিলাকে শাস্তির জন্যে তার কাছে নিয়ে আসা হলো। যিশু যখন উপলব্ধি করলেন মহিলাটি আন্তরিকভাবে অনুশোচনা করছে, তখন তিনি তাকে ক্ষমা করে দিলেন। কিছু লোকের ব্যাপারে অভিযোগ এলো তারা যিশুর নামে ভূত তাড়ায়, রোগমুক্ত করে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযান চালাবেন কি না জানতে চাইলে শিষ্যদের তিনি নিরস্ত করে বলেছিলেন, আমি প্রেরিত হয়েছি মানুষের মুক্তির জন্যে। মানুষের জীবন বাঁচানোর জন্যে। তাকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়ার জন্যে নয়।
অর্থাৎ একজন মানুষ একশটা ভুল করতে পারে। কিন্তু একটা ভালো কাজ তো সে করেছে। এই ভালোর ওপর ভিত্তি করেই আমরা চেষ্টা করি গড়ে তোলার জন্যে। যিশুর আদর্শে এটা হলো আমাদের শিক্ষা এবং নীতি। যেখানে অনৈতিকতা দেখছি, আমরা তা দূর করার জন্যে চেষ্টা করছি।
যিশুর শক্তির উৎস ছিলো তাঁর ধ্যান, তাঁর প্রার্থনা। যে ধ্যানে তিনি ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতেন। যে প্রার্থনা সম্পর্কে তিনি বলেছেন, প্রার্থনায় যা কিছু তোমরা চাও বিশ্বাস করবে তা পেয়েছ, তাহলে তা-ই পাবে। সারাদিন ধরে ভক্ত-শিষ্য-অভ্যাগতদের সাথে সময় কাটানোর পর সন্ধ্যাবেলা খানিকটা নির্জনে গিয়ে তিনি প্রার্থনায় নিমগ্ন হতেন, ভুলে যেতেন সমস্ত ক্ষুধা-ক্লান্তি-অবসাদ। অন্যদেরকেও তিনি বলতেন, অনেক কাজ করেছো, এখন ধ্যান কর। নিজেকে পর্যালোচনা কর, ভুলগুলো খুঁজে বের কর, মনের পর্দায় নিজেকে দাঁড় করাও, জীবন পরিবর্তন কর।
আমি মনে করি, ধ্যান-মেডিটেশন বা রিফ্লেকশন- যে নামেই বলি, ধ্যানের পথেই আমাদের মুক্তি। কারণ ধ্যান আধ্যাত্মিকতার দ্বার উন্মুক্ত করে আর আধ্যাত্মিকতার ফসল হলো শান্তি সমপ্রীতি সমৃদ্ধি। কারণ ইসলাম, হিন্দু, বৌদ্ধ বা খ্রিষ্ট- কোনো ধর্মই সন্ত্রাসকে সমর্থন করে না, অনৈতিকতাকে সমর্থন করে না, অশান্তিকে সমর্থন করে না।
এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে মিশনারীর উদ্যোগে প্রতিবছরই আমরা আয়োজন করি আন্তঃধর্মীয় সংলাপের। সেখানে ২০০ জন অংশ নিলে ৫০ জন মুসলমান, ৫০ জন হিন্দু, ৫০ জন বৌদ্ধ এবং ৫০ জন খ্রিষ্টান সমবেত হন। অত্যন্ত খোলামেলা এবং সৌহার্দ্যপূর্ণ পরিবেশে নিজেদের মধ্যকার দূরত্ব ঘোচাতে প্রয়াস পান।
কোয়ান্টাম এক্ষেত্রে খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। সর্ব ধর্ম প্রতিনিধিত্বের সহাবস্থানের যে দৃষ্টান্ত এখানে স্থাপিত হয়েছে তা খুবই উৎসাহব্যঞ্জক। এ সংগঠনের অগ্রযাত্রা অব্যাহত থাকুক- এটাই কামনা করি।
আর্চবিশপ পৌলিনুস কস্তা
বাংলাদেশে খ্রিষ্টান সমপ্রদায়ের সর্বোচ্চ ধর্মীয় নেতা ঢাকার আর্চবিশপ পৌলিনুস কস্তা।
সৌজন্যেঃ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন
No comments:
Post a Comment