Wednesday, November 5, 2014

২০৩. ধ্যান সমাধির পথ

শ্রী রামকৃষ্ণের জীবনটাকে আমরা বলতে পারি যে, ধর্মের একটা গবেষণাগার। তিনি ইসলাম ও খ্রিষ্টধর্মসহ বিভিন্ন ধর্মমত অভ্যাস করেছিলেন এবং উপলব্ধি করেছিলেন- ধর্মসমূহের পথ ভিন্ন হলেও সকলেরই উদ্দিষ্ট এক ও অভিন্ন- ঈশ্বরের নৈকট্য লাভ। তার ভাষায় ‘সকল ধর্মই সত্য, যত মত তত পথ’, অর্থাৎ ধর্মীয় মত ও পথ ভিন্ন হলেও উদ্দেশ্য ও গন্তব্য এক।
ঊনবিংশ শতকের প্রখ্যাত বাঙালি যোগসাধক দার্শনিক ও ধর্মগুরু শ্রী রামকৃষ্ণ। ১৮৩৬ সালে গ্রামীণ পশ্চিমবঙ্গের এক দরিদ্র ব্রাহ্মণ বৈষ্ণব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। শৈশবে গদাই নামে পরিচিত। গদাধর তাঁর গ্রামবাসীদের অত্যন্ত প্রিয় ছিলেন। অঙ্কন ও মাটির প্রতিমা নির্মাণে তাঁর ছিলো সহজাত দক্ষতা। যদিও প্রথাগত শিক্ষায় তাঁর আদৌ মনোযোগ ছিলো না। সে যুগে ব্রাহ্মণ সমাজে প্রচলিত সংস্কৃত শিক্ষাকে তিনি “চালকলা- বাঁধা বিদ্যা” (অর্থাৎ পুরোহিতের জীবিকা উপার্জনী শিক্ষা) বলে উপহাস করেন এবং তা গ্রহণে অস্বীকার করেন। তবে নতুন কিছু শিখতে তাঁর আগ্রহের অন্ত ছিলো না। গানবাজনা, কথকতা ও ধর্মীয় উপাখ্যান অবলম্বনে যাত্রাভিনয়ে তিনি পারদর্শিতা অর্জন করেন। তীর্থযাত্রী সন্ন্যাসী ও গ্রাম্য পুরাণকথকদের কথকতা শুনে অতি অল্প বয়সেই পুরাণ, রামায়ণ, মহাভারত ও ভাগবতে ব্যুৎপত্তি অর্জন করেন গদাধর।
শ্রী রামকৃষ্ণের স্মৃতিচারণা থেকে জানা যায়, ৬/৭ বছর বয়স থেকেই তাঁর মধ্যে আধ্যাত্মিক ভাবতন্ময়তা দেখা দিত। পিতৃবিয়োগের পর তাঁর অগ্রজ রামকুমার পরিবারের ভার গ্রহণ করেন ও পুরোহিতের বৃত্তি গ্রহণ করেন। দাদাকে পৌরোহিত্যে সহায়তা করার মানসে গদাধর কলকাতায় পদার্পণ করেন।
১৮৫৫ সালে কলকাতার নিম্নবর্ণের কৈবর্ত্য সমাজের এক ধনী জমিদারপত্নী রানি রাসমণি দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করলে রামকুমার সে মন্দিরে প্রধান পুরোহিতের পদ গ্রহণ করেন। ১৮৫৬ সালে রামকুমারের মৃত্যু হলে গদাধর তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন। মন্দিরের উত্তর-পশ্চিম আঙিনায় তাঁকে একটি ছোট ঘর দেয়া হয়। এ ঘরেই তিনি অতিবাহিত করেন তাঁর অবশিষ্ট জীবন।
রামকুমারের মৃত্যুর পর রামকৃষ্ণের ভাবতন্ময়তা বৃদ্ধি পায়। তার ১২ বছরের তপস্যা জীবনে তিনি দুজন গুরুর দীক্ষা লাভ করেন। তারা হলেন ভৈরবী ব্রাহ্মণী ও তোতাপুরী। ভৈরবী তাকে তান্ত্রিক সাধনা সম্পর্কে শিক্ষা দেন এবং তোতাপুরী শিক্ষা দেন বৈদান্তিক সাধনা সম্পর্কে। দীক্ষা লাভের পর তার নাম হয় শ্রী রামকৃষ্ণ পরমহংস। একইসঙ্গে রামকৃষ্ণ বৈষ্ণব সাধনায়ও সিদ্ধি লাভ করেন।
তিনি প্রথাগত সন্ন্যাসীদের সাথে একমত ছিলেন না বা তাদের মতো পোশাকও পরতেন না। ব্রাহ্মণের জাত্যাভিমান দূর করার জন্যে তিনি নিম্নবর্ণীয়দের হাতে খাদ্যগ্রহণ, অন্ত্যজ পারিয়াদের (চাকর ও ঝাড়ুদার) সেবা করতে থাকেন।
লোকশিক্ষক হিসেবে রামকৃষ্ণ পরমহংস ছিলেন খুবই জনপ্রিয়। গ্রামবাংলায় ছোট ছোট গল্পের মাধ্যমে দেয় তাঁর উপদেশাবলি জনমানসে বিস্তার করেছিলো ব্যাপক প্রভাব। ঈশ্বর-উপলব্ধিকেই তিনি মানবজীবনের সর্বোচ্চ লক্ষ্য বলে মনে করতেন। শ্রী রামকৃষ্ণের মতে, কাম ও অর্থই মানুষকে ঈশ্বরের পথ হতে বিচ্যুত করে; তাই ‘কাম-কাঞ্চন’ বা ‘কামিনী-কাঞ্চন’ ত্যাগের পথই তাঁর কাছে ছিলো ঈশ্বরের পথ। জগতকে তিনি ‘মায়া’ বলে উল্লেখ করেছেন। তাঁর মতে জগতের অন্ধকার শক্তি ‘অবিদ্যা-মায়া’ (অর্র্থাৎ কাম ক্রোধ লোভ) মানুষকে বন্ধনে ফেলে আর বিদ্যা-মায়া (অর্থাৎ আধ্যাত্মিক গুণাবলি, জ্ঞান দয়া শুদ্ধতা প্রেম ভক্তি) মানুষকে চৈতন্যের সর্বোচ্চ স্তরে নিয়ে যায়।
‘জীবে দয়া নয়, শিবজ্ঞানে জীবসেবা’- তাঁর এ উপদেশ স্বামী বিবেকানন্দের কর্মের পাথেয় হয়েছিলো। শ্রী রামকৃষ্ণ সংগঠিত করেন একদল অনুগামী, যারা ১৮৮৬ সালে তাঁর প্রয়াণের পর সন্ন্যাস গ্রহণ করে তাঁর কাজ চালিয়ে যান। এঁদেরই নেতা ছিলেন স্বামী বিবেকানন্দ।
১৮৯৩ সালে শিকাগোতে বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় বিবেকানন্দ তাঁর ধর্মীয় চিন্তাধারাকে পাশ্চাত্যের সমক্ষে উপনীত করেন। বিবেকানন্দ যে বিশ্ব মানবতাবাদের বার্তা প্রেরণ করেন তা সর্বত্র সমাদৃত হয় এবং তিনিও সকল সমাজের সমর্থন অর্জন করেন। যুক্তরাষ্ট্রে হিন্দুদর্শনের সার্বজনীন সত্য প্রচারের উদ্দেশ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন বেদান্ত সোসাইটি এবং ভারতে রামকৃষ্ণ মিশন।
একাগ্রচিত্তে ঈশ্বরভাবনা বা ধ্যানের মধ্য দিয়েই সমাধির স্তরে যাওয়ার কথা বলেছেন শ্রী রামকৃষ্ণ। তিনি এ-ও বলেছেন- শুধু চোখ বন্ধ করে বসে থাকলেই ধ্যান হয় না যদি না যাবতীয় লোভ-কামনা-বাসনা ও শত্রুভাবনা থেকে মনকে মুক্ত করা না যায়। পুনঃপুনঃ চেষ্টার মধ্য দিয়ে এ অভ্যাস আয়ত্ত করতে হবে। আবার তিনি বলেছেন, খালি পেটে ধর্ম হয় না। চোখ বন্ধ করে ধ্যান করলেই ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না। স্বামী বিবেকানন্দের ইচ্ছা ছিলো তিনি হিমালয়ে বসে ধ্যান করে করে তার শরীর ত্যাগ করবেন। শুনে শ্রী রামকৃষ্ণ ধমক দিয়েছিলেন, তুই নিজের মুক্তি চাস শুধু, এ-তো স্বার্থপরতা| আর্তের সেবা করলে তা ধ্যানেরই সহায়ক। আত্মমুক্তি ও জগতের কল্যাণসাধন- এ দুধারী আদর্শ বাস্তবায়নের জন্যেই বিবেকানন্দ প্রতিষ্ঠা করেন রামকৃষ্ণ মিশন। ধ্যান ও অপরের কল্যাণের জন্যে আমাদের সমাজে যে সকল প্রতিষ্ঠান কাজ করছে কোয়ান্টাম তাদের একটি। পাশাপাশি বিবিধ ধর্মের বাণী নিয়ে কণিকা প্রকাশের যে উদ্যোগ কোয়ান্টাম নিয়েছে তা আন্তঃধর্মীয় সম্প্রীতি প্রতিষ্ঠার এক চমৎকার পদক্ষেপ। এর মধ্য দিয়ে আমরা বুঝতে পারি ধর্মবাণীর ভাষাগত পার্থক্য থাকলেও ভাবগত পার্থক্য নেই। আমাদের সবারই লক্ষ্য- দুঃখমুক্তির মধ্য দিয়ে পরমানন্দ লাভ। ফলে আমাদের পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ এবং নিজস্ব বিশ্বাস আরো দৃঢ় হয়। এ কাজে কোয়ান্টাম আরো এগিয়ে যাক, শ্রী ভগবানের কাছে এ প্রার্থনাই করছি।
Wisdom tag: 
স্বামী স্থিরাত্মানন্দজী মহারাজ
রামকৃষ্ণ মিশনের স্বামী স্থিরাত্মানন্দজী মহারাজ

সৌজন্যেঃ কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন

No comments:

Post a Comment