Wednesday, October 8, 2014

১৮৯. হালাল-হারাম ঘোষণা করার অধিকার একমাত্র আল্লাহর

আল্লাহর ইসলাম দ্বিতীয় মৌল নীতি হিসেবে ঘোষণা করেছে যে, হালাল-হারাম ঘোষণা করার অধিকার কেবলমাত্র সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তা’লার। সৃষ্টির হাত থেকে এ কর্তৃত্ব কেড়ে নেয়া হয়েছে। আল্লাহর দ্বীনের বা বৈষয়িকতার দৃষ্টিতে তার মর্যাদা যা-ই হোক না কেন, এ অধিকার কারোরই নেই। এ কর্তৃত্ব কেবলমাত্র আল্লাহর অধিকার বলে স্বীকৃতব্য। আলেম, পীর-দরবেশ, রাজা-বাদশাহ, নেতা, আল্লাহর বান্দাদের ওপর কোন কিছু হারাম করার কোন অধিকার নেই। যদি কেউ তা করার দুঃসাহস করে তাহলে বুঝতে হবে সে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা লংঘন করছে। দ্বীনী আইন-বিধান প্রণয়নে আল্লাহর নিরংকুশ অধিকারকে যারা কেড়ে নিতে চাচ্ছে, তাদের এ কাজকে যারা খুশি মনে নেবে ও গ্রহণ করবে, অনুসরন করবে, তারা আল্লাহর সাথে তাদের শরীক করার মতো মারাত্নক অপরাধ করবে। শিরকের এ অপরাধ আল্লাহ কিছুতেই ক্ষমা করবেন না। সূরা আশ শূরার ২১ নং আয়াতে আছে,

“ওদের কি এমন শরীক বা উপাস্য আছে নাকি, যারা ওদের জন্য দ্বীনের এমন বিধান রচনা করে দিচ্ছে, যার জন্য আল্লাহ কোন অনুমতিই দেননি?”

ইয়াহুদী ও খৃস্টানরা হালাল-হারাম নির্ধারনের নিরংকুশ কর্তৃত্ব দিয়েছিল তাদের পাদ্রী ও পন্ডিতদের। কুরআন মজীদ এ দিকে ইংগিত করেই বলেছেঃ
“ওরা আল্লাহকে বাদ দিয়ে ওদের পাদ্রী পন্ডিতদের খোদা বানিয়ে নিয়েছে আর ঈসা মসীহকে। অথচ ওদের নির্দেশ দেয়া হয়েছিল কেবলমাত্র এক আল্লাহর দাসত্ব ও বন্দেগী করতে। আসলে সে আল্লাহ ছাড়া ইলাহ আর কেউ নয়-নেই। তিনি সর্বাত্মকভাবে পবিত্র, ওদের শিরকের অনেক উর্ধ্বে তিনি। (সূরা তওবাঃ ৩১)

আদী ইবনে হাতিম পূর্বে খ্রীস্ট ধর্ম অবলম্বনকারী ছিলেন। তিনি ইসলাম গ্রহণ করে যখন দেখতে পেলেন, নবী করীম (স) উক্ত আয়াত পড়ছেন, তখন তিনি বললেনঃ
“হে রাসূল! ওরা তো ওদের পাদ্রী-পন্ডিতদের ইবাদত করেনি?”
রাসূলে করীম (স) জবাবে বললেন, তাই নাকি? এ পাদ্রী-পন্ডিতরাই তো ওদের জন্যে হালাল-হারাম নির্ধারণ করে দিয়েছে এবং ওরা তা-ই সাগ্রহে ঐকান্তিকভাবে মেনে নিয়েছে। আর কুরআনে এটাকেই বলে হয়েছে ওদের ‘ইবাদত’ অর্থ্যাত এরূপ করাই ইবাদত। ‘ইবাদত’ বলতে যা বুঝায়, তা ওরা করেছে ওদের পাদ্রী-পন্ডিতদের।
অপর একটি বর্ণনায় বলা হয়েছে, নবী করীম (স) উপরিউক্ত আয়াতটির ব্যাখ্যা দান পর্যায়ে বলেছেনঃ
“ওরা ওদের পাদ্রী-পন্ডিতদের বন্দেগী করত না, এ কথা কি সত্য? কিন্তু প্রকৃত ব্যাপার এই যে, এ পাদ্রী-পন্ডিতরা যখন কোন জিনিসকে তাদের জন্য হালাল ঘোষনা করত, তখন তারাও সেটাকে হালালরূপে গ্রহণ করে নিত এবং অনুরূপভাবে যখন ওরা তাদের জন্য কোন জিনিসকে হারাম বলে দিত, অমনি তারা সেটাকে হারাম মেনে নিত। বস্তত কাউকে এরূপ অধিকার বা মর্যাদা দানই হচ্ছে তার ইবাদত করা।

খ্রীস্টানরা চিরকাল এ বিশ্বাস পোষণ করে আসছে যে, হযরত ঈসা মসীহ (আ) উর্ধ্বলোকে চলে যাওয়ার পূর্বে তাঁর ছাত্র-সাগরিদদের হালাল-হারাম করার পূর্ণ কর্তৃত্ব দিয়ে গেছেন। তারা নিজেদের ইচ্ছেমত হালাল-হারাম ঘোষণা করতে পারে। ইঞ্জিল মথি গ্রন্থে উদ্ধৃত হয়েছে,
“আমি তোমাদিগকে সত্য কহিতেছি, তোমরা পৃথিবীতে যাহা কিছু বন্ধ করিবে, তাহা স্বর্গে বন্ধ হইবে এবং পৃথবীতে যাহা কিছু মুক্ত করিবে, তাহা স্বর্গে মুক্ত হইবে।

মুশরিকদের সম্পর্কেও কুরআন মজীদে বলা হয়েছে- তারা আল্লাহর অনুমতি ব্যতিরেকে নিজেরাই হালাল হারাম নির্ধারণ করেছে।
ইরশাদ করা হয়েছেঃ
“তোমরা কি ভেবে দেখেছ, আল্লাহ তোমাদের যে রিযক দিয়েছেন, তার মধ্যে হালাল-হারাম তোমরা নির্ধারণ করে নিয়ছ? বল, আল্লাহ কি তোমাদের তা করার অনুমতি দিয়েছেন, না তোমরা আল্লাহর নামে মিথ্যা কথা বানিয়ে বলেছ?
(সূরা ইউনূসঃ ৫৯)

আল্লাহ আরও বলেছেনঃ
“তোমাদের মুখে যা আসে তা-ই বলে দিও না- এটা হালাল ও এটা হারাম। এতে করে আল্লাহর নামে সম্পূর্ণ মিথ্যা কথা চালানো হবে। আর যারাই আল্লাহর নামে এ ধরনের মিথ্যা কথা প্রচার করে, তারা কখনই কল্যাণ বা সাফল্য লাভ করতে পারে না। (সূরা নহলঃ ১১৬)

এ সব সুস্পষ্ট আয়াত ও হাদীসসমূহ থেকে নিঃসন্দেহে জানতে ও বুঝতে পারা যায় যে, হালাল-হারাম নির্ধারণ ও ঘোষণার একমাত্র অধিকার মহান আল্লাহর। একমাত্র আল্লাহ ছাড়া এ অধিকার অন্য কারো নেই, থাকতে পারে না। তিনি নিজেই এ কাজ করেছেন এবং তা তিনি তাঁর নিজের কালাম কুরআন মজীদে বলে দিয়েছেন, না হয় তাঁর নবী-রাসূলের বাণীতে ঘোষণা করিয়েছেন। হালাল-হারামকরণ পর্যায়ে আল্লাহর সিদ্ধান্তকে লংঘন করার কোন অধিকারই কারো নেই। ফিকাহবিদগণ তা করেনওনি। কুরআন মজীদে বলেই দেয়া হয়েছেঃ
“আল্লাহ যা কিছু তোমাদের জন্য হারাম করেছেন তা তিনি নিজেই সুস্পষ্ট ও ভিন্ন ভিন্ন করে তোমাদের জন্যে বলে দিয়েছেন। (সূরা আন’আমঃ ১১৯)

বস্তুত হালাল হারাম নির্ধারণও কি জায়েয, কি নাজায়েয, তা মৌলিকভাবে ও নিজস্ব মর্জি অনুযায়ী চিহ্নিত করার কোন অধিকার বা কর্তৃত্বই ফিকাহবিদদের নেই। কেননা এটা তো দ্বীনী শরীয়ত রচনা পর্যায়ের কাজ। ফিকাহবিদগণ ইজতিহাদ করতে পারেন, শরীয়তের ব্যাপারে তাঁদের মতামত- নেতৃত্ব স্বীকৃতব্য। তা সত্ত্বেও তাঁরা কোন বিষয়ে ফতোয়া দিতে রীতিমত ভয় পেতেন। একজনের কাছে ফতোয়া চাওয়া হলে অন্য জনের কাছে যেতে বলে নিজে এ কাজ এড়িয়ে যেতেন। কেননা তাঁদের ভয় ছিল, এ কাজ করতে গিয়ে কোন ভুল করে বসতে পারেন, হালালকে হারাম বা এর বিপরীত করার অপরাধ হয়ে যেতে পারে। আর তা করা কিছুতেই উচিত হতে পারে না।
ইমাম শাফিঈ তাঁর আল’আম গ্রন্থে ইমাম আবু হানিফার ছাত্র কাযী আবূ ইউসূফের একটি কথা উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেনঃ
আমি বিপুল সংখ্যক সুবিজ্ঞ ও দ্বীন পারদর্শীদের দেখেছি। তাঁরা ফতোয়া দেয়া পছন্দ করেন না। কোন জিনিসকে তাঁরা সরাসরি হালাল বা হারাম বলার পরিবর্তে কুরআনে যা আছে, কোনরূপ ব্যাখ্যা ছাড়া তা বলে দেয়াকেই যথেষ্ট মনে করতেন। বিশিষ্ট তাবেয়ী আলেম ইবনুস সায়েব বলেছেনঃ তোমরা সে রকম লোক হবে না যে বলে, আল্লাহ অমুক জিনিসটি হালাল করেছেন কিংবা এটা আল্লাহর খুব পছন্দ। কেননা কেয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘না আমি ওটাকে হালাল করেছিলাম, আর না ওটা আমার পছন্দ ছিল।‘ তেমনি সে ব্যক্তির মতও যেন তোমার অবস্থা না হয়, যে বলে, ‘অমুক জিনিসটা আল্লাহ হারাম করে দিয়েছেন।‘ কিন্তু কেয়ামতের দিন আল্লাহ বলবেন, ‘তুই মিথ্যাবাদী, আমি তো ওটাকে হারাম করিনি, ও কাজ করতে নিষেধও করে দেইনি।‘ কূফার প্রখ্যাত তাবেয়ী ফিকাহ বিশারদ ইব্রাহীম নখয়ী সম্পর্কে উদ্ধৃত হয়েছে, তাঁর ছাত্র-সাগরিদগণ যখন ফতোয়া দিতেন, তখন এটা মাকরূহ কিংবা এতে কোন দোষ নেই, প্রভৃতি ধরনের কথা বলতেন। কেননা কোন জিনিসকে হালাল বা হারাম বলে নির্ধারণ করার মত দায়িত্বহীন কাজ আর কিছু হতে পারে না।

শায়খুল ইসলাম ইমাম ইবনে তাইমিয়া বলেছেনঃ
“যে জিনিসটার হারাম হওয়ার কথা নিশ্চিত-নির্দিষ্ট-অকাট্যভাবে জানা গেছে, কেবলমাত্র সেই জিনিসটা ছাড়া অন্য কোন জিনিসের ক্ষেত্রে প্রাথমিক কালের মনীষীগণ কখনো হারাম শব্দটি প্রয়োগ করতেন না।“
অনুরূপভাবে ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল (র) কে কোন বিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে জবাবে তিনি বলতেনঃ আমি ওটাকে মাকরূহ মনে করি অথবা আমি ওটাকে ভাল মনে করি না বা পছন্দ করি না’। ইমাম মালিক, ইমাম আবু হানিফা ও অন্যান্য ইমামদের সম্পর্কেও এ কথাই সত্য।

গ্রন্থঃ ইসলামে হালাল-হারামের বিধান, আল্লামা ইউসূফ আল কারযাভী।