Tuesday, September 30, 2014

১৮৬. কোরআনের সম্মোহনী শক্তির একটি নমুনা

কোরআনের সম্মোহনী শক্তির আরো কিছু বহুল আলোচিত ঘটনা রয়েছে। এর প্রতিটি ঘটনাই প্রমাণ করে, কোরআনের প্রভাব কতো গভীর। এ ঘটনাগুলো আলোচনার আগে আমাদের পেছনের ইতিহাস স¤ক্সর্কে সামান্য কিছু কথা জেনে নিতে হবে।
জাহেলী যুগের আরব পৌত্তলিকরা বিশেষত কোরায়শদের যে শ্রেণীটি ইসলামী দাওয়াতের কঠোর বিরোধিতা করতো, তারা ব্যক্তি হিসেবে মোহাম্মদ (স.)Ñএর সত্যবাদিতায় বিন্দুমাত্র সন্দেহ পোষণ করতো না। কেননা তারা তাঁকে সত্যবাদী ও বিশ্ব¯ বলেই জানতো। নবুওত লাভের পর্বে তিনি তাদের মধ্যেই দীর্ঘ জীবন কাটিয়েছেন। এ দীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি একটি মিথ্যা কথা বলেছেন বলেও কেউ শোনেনি। অনুরূপভাবে তাঁর বিরোধিতায় নেতৃত্বদানকারী শ্রেণীটি তাঁর নবুওতের সত্যতায় সন্দেহ পোষণ করতো না, কোরআন যে আল্লাহর বাণী এবং কোনো মানুষ যে এ ধরনের বাণী রচনা করতে পারে না, তাও অবিশ্বাস করতো না। কিšু সবকিছু শুনেও তারা রসল (স.)-এর দাওয়াত গ্রহণ করতে রাযী ছিলো না। তাদের এই রাযী না হওয়ার কারণ এটা ছিলো না যে, তারা রসল (স.)-কে মিথ্যুক মনে করতো; বরং এর আসল কারণ ছিলো, তাঁর দাওয়াতে সাড়া দিলে তারা নিজেদের কায়েমী স্বার্থ তথা তাদের প্রভাব প্রতিপত্তি বিনষ্ট হবার আশংকা করতো। আল্লাহর আয়াত অস্বীকার করা ও শেরকের ওপর জিদ ধরার পেছনে তাদের এটাই ছিলো প্রধান কারণ।
কোরায়শদের এই মনোভাবের প্রকৃত কারণ ও কোরআন স¤ক্সর্কে তাদের প্রকৃত মনোভাব কী ছিলো, সে স¤ক্সর্কে একাধিক বর্ণনা পাওয়া যায়।
ইবনে ইসহাক বলেন, একদিন গভীর রাতে যখন রসল (স.) নিজ বাড়ীতে নামায পড়ছিলেন, তখন আবু সুফিয়ান, আবু জাহল ও আখনাস বিন শোরায়ক তাঁর কোরআন তেলাওয়াত শোনার জন্যে চুপিসারে বেরিয়ে পড়লো। প্রত্যেকে রসল (স.)-এর ঘরের আশে পাশে সুবিধেমতো একটা জায়গা দেখে বসে পড়লো। এদের একজন অপরজনের উপস্থিতির কথা জানতো না। সারা রাত চুপচাপ তারা কোরআন তেলাওয়াত শুনলো। ফজরের দিকে লোকজন বেরিয়ে পড়ার আগে চুপি চুপি প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়ীর দিকে রওনা দিলো। পথিমধ্যে তাদের পর¯ক্সরের সাথে দেখা হয়ে গেলে গোপনে কোরআন শোনার কথা যখন ফাস হয়ে গেলো, তখন তারা পর¯ক্সরকে তিরস্কার করতে লাগলো। বললো, এভাবে আর কখনো এসো না। অন্য লোকেরা যদি দেখে ফেলে তাহলে তাদের মনে বিরূপ ধারণার সৃষ্টি হয়ে যেতে পারে। তারপর তারা সবাই যার যার বাড়ীতে চলে গেলো। পরবর্তী রাতে এ তিন জনের প্রত্যেকে আবার গোপনে চলে এলো এবং সারা রাত ধরে কোরআন পাঠ শুনলো, ভোর হয়ে গেলে বাড়ী ফেরার পথে তারা পুনরায় পর¯ক্সরের মুখোমুখি হয়ে পড়লো। আবারো পর¯ক্সরকে পর্বের মতো ভর্ৎসনা করে সবাই চলে গেলো। তৃতীয় দিনেও একই রকম ঘটনা ঘটলো। ভোর বেলা বাড়ী ফেরার পথে যখন পর¯ক্সর মিলিত হলো, তখন তিন জনেই বললো, ‘আজ আর এভাবে চলে যাবো না। এসো আগে আমরা প্রতিজ্ঞা করি, এখানে আর কখনো আসবো না, তারপর বাড়ী ফিরবো।’ তিন জনেই এ প্রতিজ্ঞা করে বাড়ী ফিরলো। পরদিন সকালে আখনাস বিন শোরায়ক হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলো আবু সুফিয়ানের বাড়ীতে। গিয়ে বললো, ‘আবু সুফিয়ান, আমাকে বলো, মোহাম্মদের যে কালাম তেলাওয়াত শুনলে, সে স¤ক্সর্কে তোমার মতামত কী?’
আবু সুফিয়ান বললো, আখনাস, আল্লাহর কসম, যা যা শুনেছি তার কতোকটা তো আমি জানি এবং তার অর্থও বুঝি, কিšু আর কতোকটা জানিও না, তার অর্থও বুঝি না। আখনাস বললো, আমার অবস্থাও একই রকম। আবু সুফিয়ানের কাছ থেকে বেরিয়ে তারপর সে আবু জাহলের কাছে গেলো। সেখানে দুজনের মধ্যে নিুরূপ আলাপ হলোÑ 
আখনাস: আবুল হেকাম! মোহাম্মদের কাছে যা শুনলে, সে স¤ক্সর্কে তোমার অভিমত কী? সে বললো, শোনো, আমরা সব সময় বনু আবদে মানাফের সাথে মান মর্যাদা নিয়ে প্রতিযোগিতা করতাম। তারা ভোজের আয়োজন করলে আমরাও করতাম। সামাজিক দায় দায়িত্ব বহন করলে আমরাও তা বহন করতাম। তারা দান করলে আমরাও করতাম। শেষ পর্যš যখন সওয়ারী জšু জানোয়ারের ব্যাপারেও পাল্লা দিয়ে টিকে গেলাম, তখন তারা বলে বসলো, আমাদের মধ্যে একজন নবী আছে, যার কাছে আকাশ থেকে ওহী আসে। এখন তুমিই বলো, এ ক্ষেত্রে আমরা কি করে তাদের সাথে সমতা অর্জন করি? তাই আল্লাহর কসম, ওদের ওই নবীর প্রতি আমরা কখনো ঈমান আনবো না এবং কখনো তাকে সমর্থন করবো না। এ কথা শুনে আখনাস সেখান থেকে চলে এলো।
ইবনে জরীর সুদ্দী থেকে বর্ণনা করেন, বদরের যুদ্ধের দিন আখনাস বিন শোরায়ক বনু যোহরা গোত্রকে বললো, হে বনু যোহরা গোত্রের সদস্যবৃন্দ, মোহাম্মদ তো তোমাদের ভাগ্নে। ভাগ্নের আক্রমণ প্রতিরোধে তোমাদেরই দায় দায়িত্ব বেশী। সে যদি সত্যিই নবী হয়ে থাকে, তাহলে আজ তাঁর বিরুদ্ধে তোমরা লড়াই করবে না, কিšু যদি মিথ্যুক হয়ে থাকে (অর্থাৎ নবী না হয়), তাহলে ভাগ্নের আক্রমণ ঠেকানো সর্বাগ্রে তোমাদেরই কর্তব্য। মোহাম্মদ যদি জয়লাভ করে, তাহলে তো তোমরা নিরাপদেই ফিরে আসবে। আর যদি মোহাম্মদ হেরে যায়, তাহলে তোমাদের স্বজাতি তোমাদের কোনো ক্ষতি করবে না (উল্লেখ্য, বনু যোহরা গোত্রটি মদীনায় মুসলমানদের মিত্র ও রসল (স.)-এর মাতুল ছিলো)। এই দিনই তার নাম হয় আখনাস (কূপ্ররোচনাদানকারী)। তার আসল নাম ছিলো উবাই। আখনাস আবু জাহলের কাছে গিয়ে নিভৃতে বললো, আবুল হেকাম। মোহাম্মদ স¤ক্সর্কে আমাকে আসল রহস্যটা জানাও। সে কি সত্যবাদী না মিথ্যাবাদী। এখানে তুমি আর আমি ছাড়া আর কোনো কেরায়শী নেই যে আমাদের কথা শুনে ফেলবে। আবু জাহল বললো, দর বোকা! মোহাম্মদ তো সত্যবাদী। মোহাম্মদ কখনো মিথ্যা বলেনি, কিšু কথা হলো, বনু কুসাই (অর্থাৎ কোরায়শের যে শাখায় মোহাম্মদের জন্ম) যদি হাজীদের আশ্রয় দেয়া, পানি খাওয়ানো, কাবার মুতাত্তয়াল্লীগিরীÑ সব কিছুর অধিকার পাওয়ার পর আবার নবুওতও পেয়ে যায়, তাহলে বাদ-বাকী কোরায়শদের আর থাকবেটা কী?
একটি চমকপ্রদ ঘটনা
ইবনে ইসহাক বলেন, একবার বিশিষ্ট কোরায়শ নেতা ওতবা বিন রবীয়া কোরায়শদের এক বৈঠকে বসে ছিলো। মাসজিদুল হারামে রসল (স.)ও তখন একাকী বসে ছিলেন। ওতবা বললো, ‘হে কোরায়শ জনতা, আমি একবার মোহাম্মদের সাথে দেখা এবং তার সাথে আমাদের পার¯ক্সরিক সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কিছু কথা বলতে চাই। আমি চিšা করেছি, আমি তার কাছে গিয়ে কতোগুলো প্র¯াব দেবো। সে ওই প্র¯াবগুলোর কোনো কোনোটা প্রত্যাখ্যান করলেও কিছু কিছু প্র¯াব হয়তো সে গ্রহণ করবে। প্রয়োজনবোধে সে যা চাইবে আমরা তাকে তাই দেবো। তারপরও যদি সে আমাদের তার দাওয়াত থেকে অব্যাহতি দেয়, তা হলে ভালোই হবে। তোমরা কী মনে করো?’ এ সময় হযরত হামযা ইসলাম গ্রহণ করেছেন এবং কোরায়শরা দেখতে পাচ্ছিলো, রসল (স.)-এর সাথীর সংখ্যা হুহু করে বেড়ে চলেছে। তাই সবাই একমত হয়ে বললো, ‘ঠিক আছে, তুমি যাও। কথা বলো।’
ওতবা তৎক্ষণাত গিয়ে রসল (স.)-এর কাছে বসলো। তারপর বললো, ‘ভাতিজা শোনো! আমাদের গোত্রে ও আপনজনদের মধ্যে তুমি যে কতোখানি মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত আছো, তা তোমার অজানা নয়। কিšু তুমি তোমার জাতির কাছে এমন একটা আহবান নিয়ে এসেছো, যাতে তুমি তাদের সমাজে বিভেদ সৃষ্টি করেছো, তাদের স্বপ্ন ও আশা-আকাংখাকে ধলিসাত করে দিয়েছো, তাদের ধর্ম ও দেব-দেবীর নিন্দা করেছো। এখন আমি গোটা জাতির পক্ষ থেকে তোমার কাছে কয়েকটা প্র¯াব তুলে ধরছি, শোনো, এগুলো নিয়ে চিšা-ভাবনা করো। হয়তো এর কোনো না কোনোটা তুমি মেনে নিতে পারবে। রসল (স.) ওতবাকে বললেন, বলুন, আমি শুনছি। সে বললো, ভাতিজা, তুমি যে নতুন ধর্মমত নিয়ে এসেছো, তার উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে ধন স¤ক্সদ অর্জন, তাহলে আমরা তোমার জন্যে অর্থ সংগ্রহ করে তোমাকে আমাদের সবার চেয়ে বড় ধনী বানিয়ে দেবো। আর যদি তুমি সম্মান ও পদমর্যাদা চাও, তাহলে আমরা তোমাকে আমাদের এমন নেতায় পরিণত করবো যে, তোমাকে ছাড়া আমরা কোনো ব্যাপারেই সিদ্ধাš নেবো না। আর যদি তুমি রাজা হতে চাও, তবে আমরা তোমাকে রাজা বানিয়ে নেবো। আর যদি ব্যাপারটা এই হয়ে থাকে যে, তোমার কাছে যে জ্বিনটা আসে, তাকে তুমি দেখতে পাও এবং তাকে তোমার কাছ থেকে দর করতে চাও, কিšু দর করতে পারো না, তাহলে আমরা তোমার জন্যে উপযুক্ত চিকিৎসকদের ডাকবো এবং তুমি আরোগ্য লাভ না করা পর্যš আমরা তোমার পেছনে যতো অর্থ ব্যয় করা প্রয়োজন হয় করবো। কেননা অনেক সময় এমনও হয়ে থাকে যে, কোনো মানুষ যে জ্বিনকে বশীভূত করে, তা তার মনিবের ওপর প্রবল হয়ে যায় এবং চিকিৎসা ছাড়া তার কবল থেকে মুক্তি পায় না।’
এতোক্ষণ রসল (স.) ওতবার কথা মনোযোগ দিয়ে শুনলেন। অতপর বললেন, আপনার কথা কি শেষ হয়েছে? ওতবা বললো, হাঁ। রসল (স.) বললেন, এবার তাহলে আমার কিছু কথা শুনুন। ওতবা বললো, আচ্ছা বলো দেখি। রসল (স.) বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম বলে সরা হা-মীম সাজদার (৪২ নং সরা) শুরু থেকে পড়া শুরু করলেন। ওতবা গভীর মনোযোগের সাথে নি¯ব্ধ হয়ে পেছনে দু’হাত রেখে হেলান দিয়ে বসে শুনতে লাগলো। পড়তে পড়তে রসল (স.) সাজদার আয়াত পর্যš (আয়াত ৩৮) গিয়ে থামলেন এবং সাজদা করলেন। অতপর তিনি বললেন, ‘ওহে আবুল ওলীদ! যা শুনবার তা তো শুনলেনই। এখন যা করবার আপনি করুন।’ ওতবা উঠে তার সাথীদের কাছে চলে গেলো। দর থেকে তাকে দেখেই কোরায়শ নেতারা একে অপরকে বলতে লাগলো, ওতবা যে চেহারা নিয়ে এখান থেকে গিয়েছিলো, এখন তা বদলে গেছে। যখন সে তাদের কাছে এলো, তখন সবাই বললো, তোমার হয়েছে কি হে আবুল ওলীদ? (আবুল ওলীদ ওতবার পারিবারিক নাম।) সে বললো, আল্লাহর শপথ, আমি এমন বাণী শুনে এসেছি যা জীবনে আর কখনো শুনিনি। আল্লাহর কসম, ওটা জাদুও নয়, কবিতাও নয়, জ্যোতির্বিদদের ভবিষ্যদ্বাণীও নয়। হে কোরায়শ জনতা, তোমরা আমার কথা শোনো এবং এ ব্যাপারে আমার আনুগত্য করো। এ লোকটাকে ওর কাজ নিয়ে থাকতে দাও। তোমরা ওর ব্যাপারে কোনো মাথা ঘামিও না। আল্লাহর কসম, আমি ওর যে সব কথাবার্তা শুনেছি, তা একদিন বিশ্বব্যাপী আলোড়ন সৃষ্টি করবেই এবং সাড়া জাগাবেই। তারপর আরবরা যদি তোমাদের সাহায্য না নিয়েই ওর অগ্রগতি থামিয়ে দেয়, তাহলে তো ভালোই হবে। তোমাদের হ¯ক্ষেপ ছাড়াই সমস্যাটা মিটে যাবে। আর যদি সে আরবদের ওপর বিজয়ী হয়, তাহলে সে যতো স¤ক্সদের মালিক হবে, তার মালিক তো তোমরাও হবে, সে যতো মান সম্মানের অধিকারী হবে, তোমরাও ততো মান সম্মানের অধিকারী হবে। তোমরা তার সাথে মিলিত হয়ে দুনিয়ার সবচেয়ে সুখী সমৃদ্ধশালী জাতিতে পরিণত হতে পারবে। ওতবার কথা শুনে সবাই বললো, আল্লাহর কসম, হে আবুল ওলীদ, মোহাম্মদ শেষ পর্যš তোমাকেও জাদু করেছে। ওতবা বললো, আমি যা বুঝেছি তা তোমাদের বললাম। এখন তোমরা যা ভালো মনে করো, করতে পারো।
ইমাম বাগাবী তার তাফসীরে একটি হাদীস উদ্বৃত করেছেন। এ ঘটনা প্রসংগে ওই হাদীসে বলা হয়েছে, রসল (স.) সরা হা-মীম সাজদার শুরু থেকে তেলাওয়াত করতে করতে যখনই ১৪ নং আয়াতের এ কথাগুলো পাঠ করতে লাগলেন, ‘যদি তারা মুখ ফিরিয়ে নেয়, তাহলে বলে দাও, আমি তোমাদের আ’দ ও সামুদের বিকট শব্দের ন্যায় আরেকটি বিকট শব্দের ব্যাপারে সাবধান করলাম।’ অমনি ওতবা তাঁর মুখের ওপর হাত চাপা দিয়ে আÍীয়তার স¤ক্সর্কের দোহাই পেড়ে আর না পড়তে অনুরোধ করলো। অতপর সে কোরায়শদের কাছে না গিয়ে সরাসরি নিজের বাড়ী চলে গেলো এবং বেশ কিছুদিন স্বেচ্ছায় গৃহবন্দীর মতো হয়ে রইলো। তারপর যখন কোরায়শদের সাথে দেখা করে ঘটনা জানালো, তখন বললো, ‘আমি মোহাম্মদের মুখে হাত চাপা দিলাম এবং আÍীয়তার দোহাই দিয়ে তাকে থামতে বললাম। তোমরা তো জানোই, মোহাম্মদ কখনো মিথ্যা বলে না, তাই ওই আয়াত পড়ার সময় আমার আশংকা হচ্ছিলো, তোমাদের ওপর এক্ষুণি আ’দ ও সামুদের মতো আযাব নাযিল হয় কি না।
আরো একটি ঘটনা
ইবনে ইসহাক বলেন, কোরায়শদের একটি দল হজ্জের মওসুম আসন্ন দেখে একদিন তাদের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ ব্যক্তি ওলীদ বিন মুগীরার কাছে সমবেত হলো। ওলীদ তাদের বললো, হে কোরায়শ জনতা! হজ্জের মওসুম সমাগত। এ সময়ে আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে লোকজন তোমাদের কাছে আসবে। তারা তো ইতিমধ্যে মোহাম্মদের ব্যাপার-স্যাপারও শুনে ফেলেছে। এখন তোমরা তার স¤ক্সর্কে আগত হাজীদের কী বলবে সে ব্যাপারে একমত হও এবং একেকজন একেক কথা বলো না। এ রকম করলে তোমরা নিজেরাই একজন কর্তৃক আরেকজন মিথ্যুক সাব্য¯ হবে এবং একজন কর্তৃক আর একজনের মত প্রত্যাখ্যাত হয়ে পড়বে। 
সবাই বললো, ‘ঠিক আছে, তবে হে আবু আবদুশ শাম্স, বক্তব্যটা আপনিই স্থির করে দিন। আপনি যা বলে দেবেন আমরা সেটিই এক বাক্যে বলবো। ওলীদ বললো, না, প্রথমে বরঞ্চ তোমরাই বলো, আমি শুনি। তারা বললো, আমরা তো বলি, সে একজন জ্যোতিষী। ওলীদ বললো, আল্লাহর কসম, সে কোনো জ্যোতিষী নয়, জ্যোতিষীরা যেমন ছন্দ মিলিয়ে সুরেলা কন্ঠে কথা বলে, সেদিক দিয়ে তাদের সাথে তার কোনো মিল নেই। তারা বললো, তাহলে আমরা ওকে জ্বিনে ধরা বলি? ওলীদ বললো, না সে জ্বিনে ধরা নয়। জ্বিনে ধরা মানুষ জীবনে অনেক দেখেছি। সে ধরনের গলাবদ্ধতা, কু-প্ররোচনা এবং মতিভ্রম তার ভেতরে নেই। লোকেরা বললো, তাহলে আমরা ওকে কবি বলি? ওলীদ বললো, না, সে কবিও নয়। আমি অনেক রকমের কবিতা পড়েছি, তার কোনোটার সাথে এর সাদৃশ্য নেই। তারা বললো, তবে কি আমরা ওকে জাদুকর বলবো? ওলীদ বললো, আসলে সে জাদুকরও নয়। আমরা জাদুকরদের বহু জাদু দেখেছি। জাদুকরদের মতো সে কিছুই করে না। সবাই বললো, হে আবু আবদুশ্ শামস্, আপনিই বলে দিন তাহলে আমরা কী বলবো? সে বললো, মোহাম্মদের কথা বড়ই মিষ্টি, জাদুময়ী ও মোহনীয়, কিšু তোমরা এসব বলা মাত্রই তা বাতিল বলে প্রত্যাখ্যাত হবে। তবে সব দিক বিবেচনা করার পর মনে হয়, তোমাদের জন্যে সর্বাপেক্ষা গ্রহণযোগ্য বক্তব্য এটাই হবে যে, তাকে তোমরা জাদুকর প্রমাণ করতে চেষ্টা করবে। আসলেই তো সে এমন বাণী নিয়ে এসেছে, যা জাদুর মতো অলৌকিক ক্রিয়াস¤ক্সন্ন। এ বাণী পিতা ও সšানের মধ্যে, স্বামী ও ¯ীর মধ্যে এবং আÍীয়স্বজনের মধ্যে বিচ্ছেদ ঘটায়। অতপর এ বক্তব্য গ্রহণ করে সবাই ওলীদের কাছ থেকে চলে গেলো। পথে-ঘাটে মোড়ে মোড়ে বসে থেকে তারা হজ্জে আগত লোকদের মোহাম্মদ (স.) স¤ক্সর্কে সাবধান করতে লাগলো।
ইবনে জারীর বর্ণনা করেন, একবার ওলীদ বিন মুগীরা রসলুল্লাহ (স.)-এর কাছে এসেছিলো। রসল (স.) তাকে কোরআন পড়ে শুনালে কোরআনের প্রভাবে তার মন নরম হয়ে গেলো। ঘটনাক্রমে আবু জাহল ব্যাপারটা জানতে পেরে একটা সক্ষ্ম ষড়যšের জাল বুনলো। সে তৎক্ষণাত ওলীদের কাছে এসে বললো, ‘চাচাজান, কোরায়শের লোকেরা আপনার জন্যে অর্থ সংগ্রহ করতে চায়।’ সে বললো, কেন? আবু জাহল বললো, আপনাকে দেবে, কিšু আপনি যদি মোহাম্মদের কাছে যান, তাহলে লোকেরা তার সাথে যেমন আচরণ করে থাকে, আপনিও তেমনি আচরণ পাবেন (নর পিশাচটি ওলীদের মধ্যে অহংকার উস্কে দিয়ে এ ধারণা দিতে চেয়েছিলো যে, ওলীদ যেন রসল (স.)-এর চেয়েও বেশী শ্রদ্ধার পাত্র)। ওলীদ বললো, কোরায়শের নিশ্চয়ই জানা আছে, আমি তাদের মধ্যে সবচেয়ে ধনী ব্যক্তি। আবু জাহল বললো, তাহলে আপনি এমন একটা কথা বলুন, যাতে আপনার গোত্রের লোকেরা বুঝতে পারে, আপনি মোহাম্মদের প্রচারিত বাণী প্রত্যাখ্যান করেন ও অপছন্দ করেন। ওলীদ বললো, তাহলে আমি তাঁর স¤ক্সর্কে কী বলবো? আল্লাহর কসম, কবিতা স¤ক্সর্কে আমার চেয়ে অভিজ্ঞ কোরায়শ গোত্রে আর কেউ নেই এবং মোহাম্মদ যা বলে তার সাথে কবিতার কোনো সাদৃশ্য নেই। তাঁর কথায় প্রবল মোহনীয় ক্ষমতা ও আকর্ষণ রয়েছে। তাঁর কথা সকল বাতিলকে ধ্বংস করে দেয় এবং তা সব সময় বিজয়ী হয়, কখনো পরাজিত হয় না। আবু জাহল বললো, আল্লাহর কসম, আপনি যতোক্ষণ মোহাম্মদ স¤ক্সর্কে কিছু না বলবেন, ততক্ষণ জনগণ খুশী হবে না। সে বললো, ঠিক আছে, আমাকে একটু ভাবতে দাও। একটু ভেবে চিšে সে বললো, ‘এটা পুরুষানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত জাদু ছাড়া আর কিছু নয়।’ অতপর ওলীদ স¤ক্সর্কে সরা মোদ্দাসসেরের ১১-৩০ আয়াত নাযিল হয়।
অপর একটি রেওয়ায়াতে জানা যায়, কোরায়শরা বললো, ওলীদ যদি ‘সাবী’ অর্থাৎ নক্ষত্রপজারী হয়ে যায়, তবে গোটা কোরায়শ গোত্র নক্ষত্রপজারী হয়ে যাবে। (জাহেলী যুগের আরবরা তাওহীদপন্থী মুসলমানদেরকে ‘সাবী’ অর্থাৎ নক্ষত্রপজারী বলে অভিহিত করতো)। এ কথার জবাবে আবু জাহল বললো, ওলীদের নক্ষত্রপজারী হওয়া ঠেকানোর জন্যে আমি একাই যথেষ্ট। অতপর সে ওলীদের সাথে দেখা করলো। ...... ওলীদ অনেকক্ষণ ভেবে চিšে বললো, নিশ্চয়ই এটা পুরুষানুক্রমিকভাবে প্রাপ্ত জাদু ছাড়া কিছু নয়। দেখতে পাও না, সে স্বামী ¯ীতে, পিতা পুত্রে ও মনিব গোলামে বিভেদ ঘটায়?
এ রেওয়ায়াতগুলো থেকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানা যায়, যে সকল মোশরেক রসল (স.)-এর দাওয়াত মিথ্যা প্রতিপন্ন করে অস্বীকার করতো, তারা আসলে রসলের আনীত ওহীকে মিথ্যা মনে করতো না। তারা তাদের শেরেকী ধ্যান-ধারণা ছেড়ে দিতে কিছুতেই রাযী ছিল না। আর এর প্রধান কারণও এ রেওয়ায়াতগুলোতে জানানো হয়েছে। সেই কারণ হলো, রসল (স.)-এর দাওয়াত মেনে নিলে তাদের এতোকালের অন্যায়ভাবে কুক্ষিগত করা ক্ষমতা ও প্রভাব প্রতিপত্তি হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে তারা আশংকা করতো। তাদের ক্ষমতা ও প্রতিপত্তির স্থলে প্রতিষ্ঠিত হবে আল্লাহর ক্ষমতা ও প্রতিপত্তি। এটাই লা-ইলাহা ইল্লাল্লাহÑ এ কালেমার মর্ম ও তাৎপর্য এবং এ কালেমাই হচ্ছে ইসলামের ভিত্তি। তাদের মাতৃভাষার কোন শব্দের মর্ম কী, তা তারা স্বভাবতই ভালোভাবে বুঝতো, আর এ কালেমার মর্ম অনুসারে ইসলাম গ্রহণ করতে তারা ইচ্ছুক ছিলো না। কেননা এ কালেমা পড়ে ইসলাম গ্রহণের অর্থ দাঁড়ায়, মানুষের জীবনের সর্বক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালা ছাড়া অন্য যে কোনো শক্তির সার্বভৌম ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব উৎখাত করে আল্লাহর সার্বভৌম ক্ষমতা, কর্তৃত্ব ও প্রভুত্ব প্রতিষ্ঠা।

No comments:

Post a Comment